জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (Genetic Engineering)
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (Genetic Engineering)
কোনো জীব কোষ থেকে একটি নির্দিষ্ট জিন (gene) বহনকারী DNA খন্ডানু পৃথক করে ভিন্ন একটি জীব কোষের DNA এর সাথে জোড়া দিয়ে এতে কাক্ষিত বৈশিষ্টের প্রকাশ ঘটানোর কৌশলকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা জিন প্রকৌশল বলে। অর্থাৎ কোনো জীবের DNA তে অন্য কেনো জীবের কাক্সিক্ষত DNA অংশ স্থাপনের মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটানোকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলে।
চিত্র- জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগে নতুন উদ্ভিদের বংশবিস্তার
যে পদ্ধতিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কার্য সম্পন্ন করা হয় তাকে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি বা জিন ক্লোনিং বলা হয়।
এ প্রযুক্তির মাধ্যমে এক জীব থেকে অন্য জীবে কাক্সিক্ষত জিনকে স্থানান্তর করা যায়। যে জীবে জিনটি স্থানান্তর করা হয় সে জীবে কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ পায়। এরূপ জীবকে বলা হয় GMO (Genetically Modified Organism) বা GE (Genetically Engineered) বা ট্রান্সজেনিক (Transgenic) জীব।
১৯৭১ সালে বিজ্ঞানী Paul Berg প্রথম রিকম্বিনেন্ট DNA অণু গঠন করেন। এজন্য পল বার্গকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর জনক বলা হয়। Escherichia coli (E. coli) ব্যাকটেরিয়ার প্লাসমিডের মধ্যে এন্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্স জিন প্রবেশ করানোর মাধ্যমে হারবার্ট বয়ার এবং স্টেনলে কোহেন ১৯৭৩ সালে সর্বপ্রথম ট্রান্সজেনিক জীব তৈরি করেন। এর এক বছর পর রুডলফ জেনিস জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে একটি ট্রান্সজেনিক ইঁদুর তৈরি করেন যা বিশ্বের প্রথম ট্রান্সজেনিক প্রাণী।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়া বা জিন পরিবর্তনের মূলনীতি : নিচে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে জিন পরিবর্তনের মূলনীতি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো-
ধাপ-১ : যে DNA এর কোন অংশ ক্লোনিং এর জন্য নির্বাচন করা হবে তাকে অবশ্যই সঠিকভাবে আলাদা করতে হবে।
ধাপ-২ : কাক্সিক্ষত DNA টুকরার জন্য উপযোগী বাহক নির্বাচন করা হবে। যদি DNA টুকরা ক্ষুদ্রাকার হয় তাহলে প্লাজমিড জাতীয় ভেক্টরই (বাহক) আদর্শ।
ধাপ-৩ : রেস্ট্রিকশন এনজাইম ব্যবহার করে কাঙ্খিত ডিএনএ থেকে ক্লোন করার জন্য ডিএনএ টুকরা কেটে নেওয়া হয়। একই এনজাইম ব্যবহার করে বাহক ডিএনএ থেকে ডিএনএ টুকরা কেটে নিতে হয়।
ধাপ-৪ : ডিএনএ লাইগেজ এনজাইম ব্যবহার বাহক ডিএনএর মধ্যে ছেদনকৃত কাক্সিক্ষত ডিএনএ টুকরা জোড়া লাগানো হয়। এর ফলে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ উৎপন্ন হয় এবং বাহক কাঙ্খিত টুকরা বহন করে।
ধাপ-৫ : ব্যবহৃত বাহকের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে পোষক কোষ নির্বাচন করা হয়। যেমন- প্লাজমিড ভেক্টরের জন্য ব্যাকটেরিয়া কোষ আদর্শ পোষক।
ধাপ-৬ : রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ অণুর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট জিন বহনকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোর ব্যাপক বংশবৃদ্ধি ঘটানো হয় এবং এটি হচ্ছে জিন ক্লোজিং এবং এক্ষেত্রে জিনের বহু কপি তৈরি হয়।
ধাপ-৭ : এরপর রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ সঠিকভাবে তৈরি হয়েছে কি-না তা পরীক্ষা করা হয়। সঠিকভাবে প্রস্তুতকৃত রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টিস্যু কালচারের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত উদ্ভিদ কোষে প্রবেশ করানো হয়। পরে উক্ত কোষ বিভাজিত হয়ে কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যসমূহ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন উদ্ভিদ ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ সৃষ্টি হয়।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সুফল :
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে জীবজগৎ নতুন বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে। উচ্চ ফলনশীল বীজ, সারা বছর সবজি, বিভিন্ন ধরনের ফল, মাছ প্রভৃতি উৎপাদনের সফলতার জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাপক সফলতা অর্জন করছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফলে আমরা নিম্নলিখিতভাবে উপকৃত হয়ে থাকি-
কৃষিক্ষেত্রে :
বর্তমানে বিভিন্ন প্রজাতি থেকে কাঙ্খিত জিন সংগ্রহ করে ফসলী উদ্ভিদে প্রতিস্থাপন করে বা জিনের গঠন ও বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটিয়ে বর্তমানে অধিক ফলনশীল জাত উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। জিন প্রকৌশলীরা শৈত প্রতিরোধক AF জিন পৃথক করে ও অন্যান্য ফসলে সংস্থাপিত করে শৈত সহনশীল টমেটো ও অন্যান্য উদ্ভিদের জাত সৃষ্টি করেছেন। ট্রান্সজেনিক ফ্রস্টরোধী গোলআলু ইত্যেমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে।
জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে পচন রোধে বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, ফলে এসব ফসল দেরিতে পাকে, সহজে পচে না, বাহ্যিক পরিবেশে থাকা অবস্থায় দীর্ঘকাল এর সুগন্ধ, বুনট এবং মান অক্ষুন্ন থাকে। বর্তমানে সুপার রাইস বা গোল্ডেন রাইসের চাষ শুরু হয়েছে।
এ ধানের ভাত খেলে ছেলেমেয়েরা ভিটামিন- A এর অভাবজনিত কারণে আর অন্ধ হবে না এবং মায়ের দেহে রক্তশূন্যতার জন্য সৃষ্ট বিভিন্ন রোগ থেকে রেহাই পাবে। তামাক, সরিষাসহ অন্যান্য অর্থকরী ফসলের দিনে সংস্থাপনের রোগ প্রতিরোধী জাত সৃষ্টি করা হয়েছে, যা মানুষের কল্যাণ বয়ে আনবে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে ক্ষতিকারক কীট-পতঙ্গরোধী উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
চিত্র- কৃষিক্ষেত্রে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
এসব পতঙ্গনিরোধী ফসল উদ্ভিদ চাষে খরচ কম পড়ে, উৎপাদন বাড়ে, মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষা পায়।
চিকিৎসা ও ওষুধ শিল্পে :
জিন প্রযুক্তির সাফল্যময় অবদান হচ্ছে ক্লোনকৃত জিন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েক প্রকার প্রোটিন তৈরি করা। এসব কঠিন জটিল রোগ নিরাময়ে মানুষের চিকিৎসায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ইতোমধ্যে যেসব জৈব রাসায়নিক প্রোটিনসহ আবিষ্কার করা হয়েছে সেগুলো হলো- ইনসুলিন, হিউম্যান গ্রোথ হরমোন, ইন্টারফেরন ও বেটা এন্ডরপিন। ইনসুলিন ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে E.coli ব্যাকটেরিয়া থেকে ইনসুলিন তৈরি, ঈস্ট থেকে হরমোন তৈরি ছাড়াও বামনত্ব, ভাইরাসজনিত রোগ, এইডস, ক্যান্সার ইত্যাদি চিকিৎসায় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহৃত হচ্ছে। ইন্টারফেরন হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রোটিনের একটি গ্রুপ। এ প্রোটিন দেহকোষকে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং অ্যান্টিবডি উৎপাদনে বাধা দেয়। জেনেটিক্যাল উপায়ে উৎপাদিত নিয়ন্ত্রণকারী হিউম্যান গ্রোথ হরমোন পোড়া ত্বক, ফেটে যাওয়া হাড় এবং খাদ্যনালীর আলসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
জীব প্রযুক্তির ব্যবহার করে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হচ্ছে, ফলে মানুষ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা থেকে রক্ষা পাচ্ছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন অনেক উন্নত ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য উৎপাদন করা যায়। এ নতুন ঔষধ নির্দিষ্ট জিনের ক্লোনিং দ্বারা তৈরি। গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভের শিশুকে দেখে সন্তানের জেনেটিক ত্রæটিসমূহ নির্ণয় করা যায়। শিশুর জন্মের পূর্বেই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
গৃহপালিত পশু ও মৎস্য উন্নয়নে :
উন্নত জাতের পশু উৎপাদনের লক্ষ্য হচ্ছে চর্বি মুক্ত মাংস উৎপাদন, দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি, দ্রæত বিক্রয়যোগ্য করা, দ্রুত বৃদ্ধি সম্পন্ন রোগ প্রতিরোধ এবং কিছু মূল্যবান প্রোটিন উৎপাদন সমৃদ্ধ করা। বিভিন্ন ট্রান্সজেনিক প্রাণী যেমন- মুরগী, খরগোশ, গরু, ভেড়া তৈরিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইতোমধ্যে ট্রান্সজেনিক ভেড়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর প্রতি লিটার দুধে ৩৫ গ্রাম পর্যন্ত হিউম্যান আলফা অ্যান্টিট্রিপসিন প্রোটিন পাওয়া যায়। এ প্রোটিনের অভাবে এমকাইসেমা নামক মারাত্মক রোগের সৃষ্টি হয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে ভেড়ার দেহের মাংস বৃদ্ধি এবং শরীরের পশম বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা হয়েছে। উদ্ভাবিত হয়েছে ট্রান্সজেনিক ছাগল। এসব ছাগলের দুধে পাওয়া যায় এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন যা জমাট বাধা রক্তকে গলিয়ে করোনারি থ্রম্বোসিস থেকে মানুষকে রক্ষা করে।
ট্রান্সজেনিক গরু উদ্ভাবনের মাধ্যমে মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের মাতৃদুগ্ধের অতি প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ল্যাকটোফেরিনও পাওয়া গেছে। এরপর মাগুর, কৈ, লইট্যা এবং তেলাপিয়া মাছে স্যামন মাছের বৃদ্ধি হরমোনের জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে এ সকল মাছের আকার প্রায় ৬০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং দুধের সরাসরি নানাবিধ ব্যবহার থাকলেও দুধ থেকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন দুগ্ধজাত দ্রবাদি তৈরি করা হয়।
পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় :
পরিবেশে বিনা কারণে সৃষ্ট জঞ্জাল ও প্রতিরোধ এবং পরিবেশ নির্মাণ করার কাজে অণুজীবের ব্যবহার হয়ে থাকে। কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের প্রশমন ঘটানোর জন্য অণুজীবের ব্যবহার হয়ে থাকে। বায়ু দূষণ রোধে জৈব ছাঁকনি, অণুজীব থেকে জৈব জ্বালানি, পরিবেশের উপাত্ত সংগ্রহকারী জৈব সংবেদক এবং কম্পিউটারের জন্য জৈব চিপস উৎপাদন করা হয়।
এছাড়া জিন ব্যাংকে স্থাপন করে জৈব বৈচিত্র্য রক্ষা করতে ও জিন প্রকৌশল এর ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন জৈব বর্জ্যে Saccharomyces গণভুক্ত ইস্ট ও কিছু ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে গাঁজন পদ্ধতিতে বংশ বৃদ্ধি ঘটিয়ে ও তাকে পরে আলাদা করে সেসব জীবাণু থেকে প্রোটিন আহরণ করে পরিবেশ দূষণমুক্ত করা যাবে।
ফরেনসিক টেস্টের ক্ষেত্রে :
সেরোলজি টেস্ট দ্বারা মানুষের রক্ত, বীর্যরস, মূত্র, অশ্রæ, লালা ইত্যাদির ডিএনএ অথবা অ্যান্টিবডি থেকে ফরেনসিক টেস্টের মাধ্যমে অপরাধীকে সনাক্ত করা হয়।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষতিকর দিক :
১. রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ যদি কোনো কারণে ক্ষতিকর হয়ে পড়ে তাহলে এর প্রভাবে জীব জগতে বিপর্যয় নেমে আসবে।
২. নিবেদিন জিন যদি ক্ষতিকর বা বিষাক্ত প্রোটিন সংশ্লেষণ করে তাহলে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন নতুন রোগ সৃষ্টি হতে পারে।
৩. যাদের কোষে প্রবিষ্ট এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স জিন কোনো রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া স্থানান্তরিত হয় তাহলে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে ওই রোগজীবাণু দমন করা সম্ভব হবে না।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োগ :
১. জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ব্যবহৃত বায়োইনফরমেটিক্স তৈরিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।
২. জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গবেষণার তথ্য ও ফলাফল গবেষকদের মধ্যে আদান-প্রদান ও মত বিনিময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহৃত হয়।
৩. বিভিন্ন প্রাণী জিনের তথ্য এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল সংরক্ষণ করার জন্য ডেটাবেজ ব্যবহৃত হয়।
৪. এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধাপে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত বিশেষ জটিল সিস্টেম ব্যবহৃত হয়।
৫. জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়ায় গবেষণার জন্য কম্পিউটার সিম্যুলেশন ব্যবহৃত হতে পারে।