শেখ রাসেলের জীবনী

শেখ রাসেলের জন্ম, দুরন্ত শৈশব, শিক্ষা জীবন, স্বপ্ন, ভ্রমণ, পছন্দ, খেলাধুলা, তাঁর উপর রচিত গ্রন্থ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত

 

শেখ রাসেলের জন্ম

শেখ রাসেল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা অঞ্চলের ধানমন্ডিতে ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে ১৮ অক্টোবর, ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় লেখক খ্যাতিমান দার্শনিক ও নোবেল বিজয়ী বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে পরিবারের নতুন সদস্যের নাম রাখেন ‘রাসেল’।

শেখ রাসেল

শেখ রাসেলের জন্মের দু’বছর আগে ১৯৬২ সালে কিউবাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেফ-এর মধ্যে স্নায়ু ও কূটনৈতিক যুদ্ধ চলছিল।

এক পর্যায়ে সেই স্নায়ু ও কূটনৈতিক যুদ্ধটি সত্যিকারের ভয়ংকর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন, বিশ্বমানবতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল।

বার্ট্রান্ড রাসেল

মানবসভ্যতা বিধ্বংসী সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটি থামাতে তিনি সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। বিশ্ব জনমত গড়ে উঠেছিল রাসেলের যুক্তির পক্ষে। কেনেডি-ক্রুশ্চেফ এক পর্যায়ে যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।

তাই মহান বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে নাম রাখা হয় রাসেল। এই নামটিকে ঘিরে নিশ্চয়ই তার মহৎ কোনো স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা ছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন বিশ্ব মানবতার উজ্জ্বল দ্যুতি, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু, বাঙালি জাতির জনক, মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা।

বার্ট্রান্ড রাসেল কেবলমাত্র একজন দার্শনিকই ছিলেন না, বিজ্ঞানী ছিলেন। ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের বিশ্বনেতাও। বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্যে বার্ট্রান্ড রাসেল গঠন করেছিলেন—কমিটি অব হানড্রেড। এই পৃথিবীটাকে মানুষের বসবাসের জন্য সুন্দর ও শান্তিময় করার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন তিনি নিরলস।

পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল সর্বকনিষ্ঠ। ভাই-বোনের মধ্যে অন্যরা হলেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম সংগঠক শেখ কামালবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা শেখ জামাল এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ শেখ রেহানা। শেখ রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তান

 

দুরন্ত শৈশব

শেখ রাসেল ছিলেন ভীষণ দুরন্ত। তার দুরন্তপনার সঙ্গী ছিল বাই-সাইকেল। তিনি রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ছাড়াই সাইকেলে করে স্কুলে যেতেন। পাড়ার আর দশজন সাধারণ ছেলের মতো।  বিখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মুসা স্মৃতিকথায় শেখ রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কদিন বিকেল পাঁচটার দিকে শাঁ করে ৩১ নম্বরের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে ৩২ নম্বরে ঢুকেই আমার সামনে একেবারে পপাতধরণিতল। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ ছেলেটি। …অতঃপর সাইকেলে উঠে লেকপাড়ে উধাও হলো শৈশবের শেষ প্রান্তের ছোট্ট ছেলেটি। …বিকেলে লেকের পূর্বপাড়ে এমনি করে চক্কর মারত। মধ্যবর্তী ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্বপ্রান্তের সাদা একটি দালান পর্যন্ত সাইকেলারোহীর দৌড়ানোর সীমানা। …এদিকে ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মা, তীক্ষ দৃষ্টি রাখতেন দুষ্টু ছেলেটির সাইকেল-পরিক্রমা যেন সীমাবদ্ধ থাকে।’

শেখ রাসেলের সাইকেল চালানো শখ

ধানমন্ডি লেকের পূর্বপাড়। ৩১ ও ৩২ নম্বর সড়ক। দুরন্ত গতিতে সাইকেল চালাতো এক শিশু। ব্র্রেক কষতে গিয়ে অথবা মোড় ঘোরার সময়- কখনো পড়ে যেতো। রাসেলের ছোট একটি সাইকেল ও মপেট মটরসাইকেল ছিলো। সেটি নিয়ে সে কখনও বাসায় কখনও রাস্তায় ঘোরাঘুরি করত। পাশের বাসার দুটো ছেলে আদিল ও ইমরান দু’ভাই রাসেলের সঙ্গে খেলাকালীন সময়ে এক্সিডেন্ট হয়।

কিন্তু- কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই- হাওয়ার বেগে সাইকেলটা তুলে নিয়ে চোখের পলকে প্রজাপতির মতো উড়ে যেতো। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলের দুরন্তপনা ছিল এমনই। তাকে নিয়ে, নিজের স্মৃতিগ্রন্থে, এসব অভিজ্ঞতার কথাই লিখেছেন প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা।

 রাসেলের শৈশব আখ্যান যেন আমাদের সকলের শৈশবের গল্প বলে দেয়। তার শৈশবের গল্প কথাগুলির মধ্যে আমরা যেন বারবার নিজেদেরই খুঁজে পাই। পড়াশোনা, খেলাধুলা, দুরন্তপনা এসব নিয়ে রাসেল আমাদের সকলের কাছেই হয়ে ওঠে শৈশবের এক মূর্ত প্রতিমূর্তি।

 শিক্ষা জীবন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে পরিবারের সদস্যদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। তখন রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।

ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ

স্বপ্ন

রাসেলের স্বপ্ন ছিল সে সেনাবাহিনীর অফিসার হবে। গ্রামে গেলে বাচ্চাদের সে প্যারেড করাত। রাসেলের ইচ্ছায় শিশুদের কাপড় দিতে হতো। ওর মনটা ছিল খুব উদার।

১৯৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় রাসেলের বয়স ছিল মাত্র সাড়ে চার বছর, আর ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সাত বছর। বাঙালি জাতির ভাগ্যনির্ধারণী এই দুটি মাইলফলক- দাগ কেটেছিল রাসেলের শিশু মনে। তাই বড় হয়ে সেনা কর্মকর্তা হতে চেয়েছিল সে। টুঙ্গিপাড়ায় ঘুরতে গেলে- গ্রামের শিশুদের নিয়ে প্যারেড করতো, ডামি বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতো।

 

ভ্রমণ

মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপান বাংলাদেশকে নানানভাবে সাহায্য করে, তাই যুদ্ধ শেষে সেই জাপান বঙ্গবন্ধুর গোটা পরিবারকেই জাপানে আমন্ত্রন জানায়, বিশেষ করে রাসেলের কথা উল্লেখ করে। সেই সফরে রাসেল ও তার বোন রেহানা জাপান যায়। সেখানে রাসেলের জন্য বিশেষ কর্মসূচিরও আয়োজন করা হয়। ১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জাপানে এসেছিলেন। তখন রাসেলের ৯তম জন্মদিন। ওই সময়ে রাসেল জাপানে এসে জাপানি সংস্কৃতি উপভোগ করে খুবই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এছাড়া রাসেল তৎকালীন সময়ে জাপানি স্কুল শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।

বিশেষ মুহূর্তে বাবার সাথে শেখ রাসেল

পছন্দ

রাসেল পোষাকের ব্যপারে আগ্রহী ছিলো। নতুন পোষাক খুব পছন্দ করতো। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু যে পোষাক পরতো রাসেলও তা পছন্দ করতো বলতে গেলে অনুসরন করতো। বিভিন্ন সময়েই রাসেল তার বাবার সাথে নানান প্রোগ্রামে যেত তাই তার মা রাসেলকে একটা প্রিন্স স্যুট বানিয়ে দেন যাতে বাবার সাথে তাকে খুব সুন্দর মানায়।
জাপান সফর

ফাল্গুনের চপলা-চঞ্চল বাতাসের মতো উড়ু উড়ু- তুমুল প্রাণবন্ত এক শিশুর নাম শেখ রাসেল। কিন্তু তার মানসপটে ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছিলো এক সুকোমল মানবিক সত্তা। এমনকি- পরবর্তীতে- প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবেও তার মধ্যে ছিল না কোনো অহমিকা।

ছোট থেকেই খাবারের প্রতি আগ্রহ কম ছিল রাসেলের। তবে রান্নাঘরে- সবাই যখন খেতে বসতো, তখন কাজের লোকদের সঙ্গে পিঁড়ি পেতে বসে, লাল ফুল আঁকা থালায় করে, ভাত খেতে পছন্দ করতো সে। নিজের পছন্দের খাবারের ভাগ দিতো- প্রিয় কুকুর টমিকে। টমি নামে একটি কুকুর ছিল যার সাথে ছোট্ট রাসেল খেলে বেড়াতো। একদিন খেলার সময় কুকুরটি জোরে ডেকে উঠলে ছোট রাসেলের মনে হয় টমি তাকে বকেছে।  শিশু রাসেল তার আপা রেহানার কাছে এসে কাঁদতে থাকেন।

সকালে-সন্ধ্যায় খোঁজ রাখতো পোষ্য পায়রাগুলোর, আদর করে হাত বোলাতো গোয়ালের গরুর গায়ে।

শেখ রাসেলের শখ-কবুতর নিয়ে লেখা করা

আরো শোনা যায় রাসেলের মাছ ধরার খুব শখ ছিল।

মাছ ধরে আবার সেই মাছ সে পুকুরেই ছেড়ে দিত। এই ছিল তার মজা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের জন্ম হলে রাসেল জয়কে নিয়ে খেলত সারাদিন।

গৃহশিক্ষিকার সঙ্গেও ছিল তার আদর-আবদারের সম্পর্ক। পরিবারের সদস্যদের মতোই তাকেও ভালোবাসতো রাসেল।

স্বাধীনতার পর- প্রথমবারের মতো পরিবারের সবাইকে নিয়ে প্রাণোচ্ছ্বল সময় কাটানোর সুযোগ আসে রাসেলের জীবনে। সুযোগ পেলেই বাবার আশেপাশে থাকতো। কখনো বিদেশ ভ্রমণের সময় ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গী হতো সে। ছোট্ট রাসেলের উচ্চ শির ও আত্মবিশ্বাসী চাহনিতে মুগ্ধ হতো বিশ্বনেতারা।

১৯৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় রাসেলের বয়স ছিল মাত্র সাড়ে চার বছর, আর ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সাত বছর। বাঙালি জাতির ভাগ্যনির্ধারণী এই দুটি মাইলফলক- দাগ কেটেছিল রাসেলের শিশু মনে। তাই বড় হয়ে সেনা কর্মকর্তা হতে চেয়েছিল সে। টুঙ্গিপাড়ায় ঘুরতে গেলে- গ্রামের শিশুদের নিয়ে প্যারেড করতো, ডামি বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতো।

রাসেল ছোটবেলা থেকেই ছিল খুব সাহসী, সাবধানী ও উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন। খুব ছোটতে, কালো পিঁপড়া দেখলেই ধরতে যেত। একদিন একটা বড় ও বিষাক্ত কালো পিঁপড়া কামড়ে দেয় তাকে। এরপর থেকে, বড়-কালো পিঁপড়া দেখলেই বলতো ‘ভুট্টো’। পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে আপামর বাঙালির মুক্তির স্লোগান শুনতে শুনতে- আক্রমণকারী শক্তির নাম ভুট্টো হিসেবে চিত্রিত হয়েছিল রাসেলের মানসপটে।

বড়-কালো পিঁপড়া

‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে, ১৯৬৭ সালের ২৭ এবং ২৮ মে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে- ৬ দফা মানতে হবে- সংগ্রাম- সংগ্রাম- চলবে চলবে–।’ বঙ্গবন্ধুর বিস্ময় মেটাতে বঙ্গমাতা তখন জানান, সড়কের মিছিল এবং বাসায় আয়োজিত রাজনৈতিক বৈঠকগুলো থেকে- এসব কথা রাসেল নিজে নিজেই শিখেছে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের আবহে বেড়ে ওঠা শিশু রাসেলের কোমল মন- ক্রমেই বিকশিত হচ্ছিলো- এক নিরন্তর দেশপ্রেমিক হিসেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। ১১তম জন্মদিনের আগেই, বর্বর ঘাতকরা, পরিবারের সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করে তাকে।

তবে অকাল মৃত্যুর অন্ধকারে হারিয়ে যায়নি রাসেল, আবহমান বাংলার চিরায়ত শিশুর প্রতিকৃতি হিসেবে- প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে- বেঁচে আছে সে, বেঁচে থাকবে অনন্তকাল ধরে। রাসেলের অনুকরণীয় শৈশব- প্রতিদিন স্বপ্ন ছড়িয়ে যাবে বাংলার প্রতিটি শিশুর মনে।

শেখ রাসেলের অনুকরণীয় শৈশব

তাঁর উপর রচিত গ্রন্থ

 

আমাদের ছোট রাসেল সোনা-লেখক শেখ হাসিনা
কারাগারের রোজনামচা

বঙ্গবন্ধু বই

কেন শেখ রাসেল আমাদের বন্ধু?

শেখ রাসেল কেন আমাদের বন্ধু, কীভাবেই বা তিনি আমাদের বন্ধু হয়ে উঠলেন বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে রাসেলের ছেলেবেলার দিনগুলিতে। তার ছেলেবেলার দিনগুলো সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তার অধিকাংশই শিশু বয়সের নিষ্পাপ আত্মভোলা কর্মকাণ্ড।

এক মর্মস্পর্শী পুনর্মিলনী

দীর্ঘ প্রায় দশ মাসের বিচ্ছেদের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হলেন, তখন এক হৃদয়স্পর্শী পুনর্মিলন দৃশ্যের অবতারণা হয়। বিচ্ছেদের এই পুরোটা সময় তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে, তিন ছেলেসহ পরিবারের বাকি সদস্যরা কাটিয়েছেন আশা-নিরাশার দোলাচলের এক তীব্র যন্ত্রণার জীবন। খবর বিএসএস।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁর পরিবারের সদস্যদের ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ১৮ নম্বর সড়কের যে বাড়িটায় গৃহবন্দী করে রেখেছিল, শেখ মুজিব যখন সেখানে ঢুকলেন, তখন তাঁর বড় মেয়ে (শেখ) হাসিনা প্রথম তাঁকে বরণ করে নেন।

পরিবারের সাথে বঙ্গবন্ধু

সেটা এমন এক মুহূর্ত ছিল, যা বর্ণনা করার ক্ষমতা ভাষার নেই। আবেগরুদ্ধ হাসিনার কাছেও কোনো ভাষা ছিল না। যে বাবার বুকে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তিনি নিজেই তখন কান্না সামলাতে যুদ্ধরত। সুখে আর নতুন করে পাওয়া এক নিশ্চয়তাবোধে দুজনেই কাঁদতে শুরু করলেন। মেয়ের কানে কানে অস্ফুটে কোনো একটি আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করে শেখ মুজিব এগিয়ে গেলেন সামনে। তিনি যখন বড় হলরুমে হাঁটছেন, তখন ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরী ও নারীর দল তাঁর ওপর পুষ্পবৃষ্টি করল।

হলরুমেই ছোট মেয়ে (শেখ) রেহানাসহ আত্মীয় ও অতিথিদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ হলো। তাঁদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে পরের ঘরটিতে যেতে তাঁকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হলো। তাঁর জন্য সেখানে প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁর নব্বই বছর বয়সোত্তীর্ণ বৃদ্ধ বাবা।

শেখ মুজিব পরম শ্রদ্ধায় বাবার পা ছুঁলে বৃদ্ধ মানুষটির চোখ পুনর্মিলনের আনন্দ ও গৌরবে ছলছল করে উঠল।

কিন্তু সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী মুহূর্তটির তখনো বাকি ছিল। সেই মুহূর্তটি এল কিছুক্ষণ পরে, শেখ মুজিব যখন তাঁর আশি পেরোনো মায়ের সামনে এগিয়ে গেলেন। মাকে জড়িয়ে ধরে লৌহমানব হিসেবে পরিচিত শেখ মুজিব শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পুরো ঘরের দখল নিয়ে নিল নীরবতা। এই পুনর্মিলন দৃশ্যের সাক্ষীদের অনেকেই কিছুক্ষণের মধ্যে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

শেখ মুজিব ঘরে পৌঁছেছিলেন ৫টা ৩৫ মিনিটে। বাড়ির বাইরে তখন অগণিত মানুষের ভিড়। তারা তাদের নেতাকে ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ স্লোগানে সম্ভাষণ জানাচ্ছিল।

নাচতে আর গাইতে থাকা মানুষের ভিড় বাড়ির সবকটি প্রবেশপথ এমনভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল যে শেখ মুজিবের সঙ্গে মিলিত হতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয়। প্রেসিডেন্ট মুজিব বাড়ির বসার ঘরে ৬টা ১৫ মিনিটে ফিরে এসে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।

ওই মুহূর্তে কোনো ধরনের সংবাদ বিবৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মুজিব শিগগিরই একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকার কথা জানালেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেখানে উপস্থিত সাংবাদিক ও অতিথিদের অনুরোধ করলেন, যেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ করে দেন। আকাশপথে দীর্ঘ ২৭ ঘণ্টার ভ্রমণে তিনি ক্লান্ত।

তোমার মার বাড়ি তুমি যাও

‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো’। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’

‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম।

আমাদের ছোট রাসেল সোনা-লেখক শেখ হাসিনা

রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত।’

রাসেলকে নিয়ে ‘কারাগারের রোজনামচা’র ২৭ শে মে এবং ২৮ শে মে ১৯৬৭ সালের স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে ৬ দফা মানতে হবে- সংগ্রাম, সংগ্রাম- চলবে চলবে-পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ভাঙা ভাঙা করে বলে কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ ও শিখল কোথা থেকে। রেণু বলল, বাসায় সভা হয়েছে তখন কর্মীরা বলেছিল, তাই শিখেছে’।

কারাগারের রোজনামচা

উপসংহার:

শেখ রাসেল বাঙালি জাতির কাছে এক যুগোত্তীর্ণ ব্যক্তিত্ব। বাঙালি জাতি তার মধ্যে খুঁজে পায় রূপকথার মতো নিজেদের ছেলেবেলাকে। শেখ রাসেলের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে আপামর বাঙালির শৈশব। অন্যদিকে তার নির্মম মৃত্যুর কাহিনী বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের দেশের করুণ ইতিহাসের কথা। সেই সমস্ত নৃশংস ক্ষমতালোভী মানুষের কথা যারা কেবলমাত্র ক্ষমতার লোভে ১১ বছরের একটি ছোট্ট শিশুকে অবধি রেহাই দেয়নি।

যে জাতি নিজের ইতিহাস থেকে বিস্মৃত হয়, তারা সভ্যতার ইতিহাসে স্থবির হয়ে পড়ে। শেখ রাসেল বাঙালি জাতির সেই ইতিহাসের এক জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি। তার স্মৃতিকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশে গঠন করা হয়েছে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদ। শেখ রাসেলের নামে রাজধানী ঢাকার বুকে নামাঙ্কিত হয়েছে একটি স্কেটিং স্টেডিয়াম।

Prokash IT Care

এভাবেই চিরকাল শেখ রাসেল অমর হয়ে থাকবেন বাঙালি জাতির স্মৃতিতে।

 

শেখ রাসেল দীপ্ত জয়োল্লাস অদম্য আত্নবিশ্বাস 

বইটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুনঃ

CamScanner 09-05-2022 13.16

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page

Scroll to Top