মাঙ্কিপক্স কখন থেকে শুরু, মাঙ্কিপক্স ভাইরাস, প্রজাতি, শনাক্ত, প্রাথমিক উপসর্গ লক্ষণ, কিভাবে ছড়াতে পারে, এবং ডব্লিউএইচওর সতর্কতা, চিকিৎসা ও টিকা, উপসর্গ দেখা দিলেই আইসোলেশন, মানব স্বাস্থ্যের নতুন চ্যালেঞ্জ
মাঙ্কিপক্স কখন থেকে শুরু, মাঙ্কিপক্স ভাইরাস, মাঙ্কিপক্স প্রজাতি, মাঙ্কিপক্স শনাক্ত, মাঙ্কিপক্স প্রাথমিক উপসর্গ লক্ষণ, মাঙ্কিপক্স কিভাবে ছড়াতে পারে, মাঙ্কিপক্স এবং ডব্লিউএইচওর সতর্কতা, মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসা ও টিকা, মাঙ্কিপক্স: উপসর্গ দেখা দিলেই আইসোলেশন, মাঙ্কিপক্স মানব স্বাস্থ্যের নতুন চ্যালেঞ্জ
মাঙ্কিপক্স কখন থেকে শুরু
মাঙ্কিপক্সের নামকরণ করা হয় ৬৪ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে। ১৯৫৮ সালে বানরের দেহে এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হওয়ায় এর নামকরণ হয় মাঙ্কিপক্স। যদিও এখন ইঁদুরকেই বিস্তারের প্রধান পোষক হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে।
১৯৭০ সালে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোতে যখন গুটিবসন্ত নির্মূলের জোরসোর চেষ্টা চলছে তখনই আবার মাঙ্কিপক্সের প্রথম কেস রেকর্ড করা হয়েছিল।
১৯৭০ সালের পর থেকে আফ্রিকার ১১ দেশে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। আমদানি করা প্রাণীর দেহ থেকে দেশটিতে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেই সময় দেশটির ছয়টি প্রদেশের ৭১ জনের শরীরে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছিল। ২০১৭ সালের পর নাইজেরিয়ায় এবার সবচেয়ে বেশি এ রোগের প্রকোপ দেখা গেছে। দেশটিতে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের দেহে উপসর্গ দেখা গেছে এবং ১৫ জনের সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
মাঙ্কিপক্স ভাইরাস
মাঙ্কিপক্স একটি ডিএনএ ভাইরাস। তাই এটি কোভিড বা ফ্লুর মতো এর দ্রুত রূপান্তর বা মিউটেশন হয় না। সাধারণত হালকা ভাইরাল সংক্রমণের জন্য দায়ী এই ভাইরাস। ভাইরাসটি গুটিবসন্তের মতো ভাইরাল প্রজাতির সদস্য। এই প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ভেরিওলা ভাইরাস, ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাস ও কাউপক্স ভাইরাস।
মাঙ্কিপক্সের উপসর্গের মধ্যে আছে জ্বর, তীব্র মাথা ধরা, পেশি শুল, ব্যাক পেইন, শরীরে বল–শক্তি কম, গ্লান্ড ফোলা, ত্বকে ফুসকুড়ি (র্যাশ)। জ্বর হওয়ার ১ থেকে ৩ দিন পর ফুসকুড়ি, চ্যাপ্টা ক্ষত, ভেতরে হলুদ তরল পরে শুকায়, মামড়ি হয় আর খসে পড়ে। মুখে, হাতের তেলো আর পায়ের নিচে হয় ফুসকুড়ি। চোখে বা যৌনাঙ্গেও হতে পারে।
শিশু, যাদের দেহ প্রতিরোধ দুর্বল, তাদের হতে পারে কখনো জটিল। ত্বক সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, হতবুদ্ধি, চোখের অসুখ, দৃষ্টি সমস্যা।
যাদের মাঙ্কিপক্স, তাদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে হতে পারে অন্যের। ফুসকুড়ি, দেহ তরল, ত্বক ক্ষত থেকে তরল, পুঁজ, রক্ত মামড়ি খুব সংক্রামক। সংক্রমিত ব্যক্তির পোশাক–পরিচ্ছদ, তোয়ালে—এসব সংক্রামক। মুখের আলসার ক্ষত, ঘা হতে পারে সংক্রামক।
শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। গুটিবসন্তের নতুন কয়েকটি টিকা মাঙ্কিপক্সের বেলায় সুরক্ষা দিতে পারে। ২০১৯ সালে অনুমোদন পাওয়া গুটিবসন্তের টিকা এমভিএ–বিএন (ইনভ্যামিউন, ইমভ্যানেক বা জাইনেওস নামেও পরিচিত) হতে পারে মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে কার্যকর।
মাঙ্কিপক্স প্রজাতি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে পরীক্ষা করে মাঙ্কিপক্সের দু’টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর একটি ‘কঙ্গো প্রজাতি’ এবং অপরটি ‘মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি’।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ‘কঙ্গো প্রজাতি’র প্রাদুর্ভাব অত্যন্ত গুরুতর। ওই অঞ্চলে কঙ্গো প্রজাতিতে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশেরও বেশি। ভয়াবহ হচ্ছে, এতে বাচ্চাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে, ‘মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি’র তীব্রতা তুলনামূলক কম। এই প্রজাতিতে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার ১ শতাংশের মতো।
মাঙ্কিপক্স শনাক্ত
৭ মে প্রথম একজন ইউরোপীয় নাগরিকের দেহে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার উষ্ণ ও আর্দ্র বনাঞ্চলের বানররা ছিল এ রোগের প্রথম শিকার। এরপর একসময় মানবদেহেও সংক্রমণ ঘটায় এই ভাইরাসটি।
ইতিমধ্যে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্যেও এই রোগটি শনাক্ত হয়েছে। আফ্রিকার বাইরে ‘মাঙ্কিপক্সের’ এই অস্বাভাবিক বিস্তার বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূত্রমতে, এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১১৫ জনের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে বা সন্দেহভাজন আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। সন্দেহভাজন আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশও রয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি দেশে শিগগিরই এই ভাইরাস ছড়াতে পারে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে সতর্ক করা হচ্ছে।
মাঙ্কিপক্স প্রাথমিক উপসর্গ লক্ষণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে প্রাথমিক উপসর্গের মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, পিঠ ও গায়ে প্রচণ্ড ব্যথার মতো লক্ষণ। কাঁপুনি ও ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া দেহের বিভিন্ন লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠে। সেই সঙ্গে মুখে ছোট ছোট ক্ষতচিহ্ন দেখা দিতে থাকে। ধীরে ধীরে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সেই ক্ষত।
মাঙ্কিপক্সের উল্লিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে বা শরীরে ফুসকুড়ি–জাতীয় কিছু হলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে আইসোলেশনে রাখা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যেহেতু ‘মাঙ্কিপক্স’ মূলত গুটিবসন্ত বা চিকেনপক্স গোত্রের রোগ, তাই বেশির ভাগ রোগীই সুষম খাবারদাবার গ্রহণসহ পরিমিত বিশ্রাম নিলে চিকিৎসা ছাড়াই দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। যদিও এটি গুটিবসন্তের চেয়ে কম মারাত্মক, তবুও এই রোগটি করোনার মতো মহামারি আকারে ছড়ানোর আগেই আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তাহলেই কেবল খুব সহজেই এই রোগটি মোকাবিলা করা সম্ভব বলে আশা করা যায়।
মাঙ্কিপক্স কিভাবে ছড়াতে পারে
ফাটা বা অমসৃণ খসখসে ত্বক (যদিও তা দেখা যায় না), শ্বাসতন্ত্র অথবা চোখ, নাক ও মুখ, সংক্রমিত প্রাণীর কামড়, আক্রান্ত প্রাণী অথবা মানুষের রক্ত, শরীরের তরল বা পশম স্পর্শ করা, সংক্রমিত প্রাণীর মাংস সঠিকভাবে রান্না ছাড়া খাওয়া হলে, ফুসকুড়ি রয়েছে এমন কারও ব্যবহৃত পোশাক, বিছানা অথবা গামছা স্পর্শ করা, মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কারও ত্বকের ফোসকা অথবা খোসপাঁচড়া স্পর্শ করা অথবা সংক্রমিত ব্যক্তির কাশি ও হাঁচির খুব কাছাকাছি যাওয়ার মাধ্যমে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বানর, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, এমনকি মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত বিছানাপত্র থেকেও এই ভাইরাস অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে।
মাঙ্কিপক্স এবং ডব্লিউএইচওর সতর্কতা
এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ অথবা টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। অতীতে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ রোধে গুটিবসন্তের টিকা ব্যবহার করা হতো বলে জানা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে শতকরা ৮৫ ভাগ কার্যকর। যুক্তরাজ্যে ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে।
মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসা ও টিকা
এই ভাইরাসের কোন চিকিৎসা নেই। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গুটি বসন্তের টিকা এবং ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধ মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ রোধে সাহায্য করতে পারে।
যে কোনো ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মতোই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে এর প্রকোপ রোধ করা যায়। যেহেতু এ রোগ প্রাণঘাতী নয় তাই এটি নিয়ে উদ্বেগের তেমন কারণ নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মাঙ্কিপক্সের যে কঙ্গো ধরনটি অপেক্ষাকৃত ভয়ানক ধরা হয়, তাতে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশ। আর পশ্চিম আফ্রিকা ধরনটিতে মৃত্যুর হার ১ শতাংশ।
ডব্লিউএইচওর মতে, এরই মধ্যে নতুন টিকা তৈরি করা হয়েছে, যা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধের জন্য অনুমোদিত হয়েছে। গুটিবসন্তের চিকিৎসার জন্য উদ্ভাবিত একটি অ্যান্টিভাইরাল অ্যাজেন্টকেও মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসার জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
এই ভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার পর এর ওষুধ বা ভ্যাকসিন নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। প্রাথমিকভাবে এর সংক্রমণ রোধে গুটিবসন্তের টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর। রোগীদের সেবা দেওয়ার সময় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে যারা আছেন, সেসব স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ইতোমধ্যে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া শুরু করেছে যুক্তরাজ্য।
মাঙ্কিপক্স: উপসর্গ দেখা দিলেই আইসোলেশন
ভয়াবহ রোগ মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে দেশে সতর্কতার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পাশাপাশি সন্দেহজনক ও লক্ষণযুক্ত মাঙ্কিপক্স রোগীদের ঢাকায় আইসোলেশনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ও আইইডিসিআরে তাদের বিষয়ে তথ্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১৪টি দেশে ৯২ জন মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা মহামারির মতোই এখন এই নতুন ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
মাঙ্কিপক্স মানব স্বাস্থ্যের নতুন চ্যালেঞ্জ
২২ মে পর্যন্ত ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্য অঞ্চলের ১২টি দেশে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট গ্লোবাল হেলথের তথ্য বলছে, বিশ্বে এখন পর্যন্ত ১১১ জন মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে সংক্রমিত অথবা সন্দেহভাজন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। এই ১২টি দেশ হচ্ছে- অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।