করোনা মহামারিতে শিক্ষা জীবন ও অনলাইন ক্লাসের প্রভাব এবং প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণায় উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি।
করোনা মহামারিতে শিক্ষা জীবন ও অনলাইন ক্লাসের প্রভাব এবং প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণায় উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি।
সেপ্টেম্বর ১২ তারিখ থেকে একযোগে সারা বাংলাদেশে প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ক্লাসসমূহ প্রতিষ্ঠান খুলবে।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ সারা বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোভিড-১৯ এর কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে ছুটি ধাপে ধাপে বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের আগষ্ট ১২ তারিখ পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। সেপ্টেম্বর ১২ তারিখ থেকে একযোগে সারা বাংলাদেশে প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ক্লাসসমূহ প্রতিষ্ঠান খুলবে এবং অফলাইনে সরাসরি ক্লাস চলবে। ইত্যেমধ্যে সকলের মধ্যে চাঙ্গাভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য সরাসরি ক্লাস আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে আর বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের সরাসরি ক্লাস আগামী অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে চালুর কথা রয়েছে।
বর্তমানে করোনা আক্রান্তের হার ১০% এর নিচে নেমে এসেছে। কিছুদিন আগে নতুন করে ভারতের করোনার ভ্যারিয়েন্ট পাওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাসহ নতুন নতুন জেলা খুলনা, বাগেরহাট, মেহেরপুর, রাজশাহীতে আক্রান্ত ও মৃত্যু হার দুইই বেড়ে গিয়েছিল এবং গত এক মাস আগে আক্রান্তের হার ৩০% এর উপরে উঠেছিল। আর দিনে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ২৬৫ জনে পোঁছায়।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বন্ধুর সাথে সেই আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদান আটকে আছে। বন্ধুর সাথে হাত ধওে মাঠে ঘোরা, টিফিন ভাগাভাগি করে খাওয়া সবই এখন স্মৃতি। এগুলোকে বাদ দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে জুমে ক্লাস করা, হোয়াটস অ্যাপে পরীক্ষা দেওয়া, পরীক্ষা শেষে খাতা পিডিএফ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গ্রুপে পাঠানো এবং অনলাইনে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা। মহামারির এই হতাশার মধ্যেই তথ্য প্রযুক্তির প্রতি আরো বেশি পারদর্শী হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা তাদের অজান্তেই।
অনলাইন ক্লাস চলাকালিন শিশুর অবস্থা
দশম শ্রেণির জিহান রহমান নামের এক ছাত্রী তার নিজের অভিজ্ঞতা কথা এভাবে জানায়- আগে ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে না খেয়ে দৌড়ানো লাগতো স্কুলের রাস্তায়। কোন পরিবহন না পেলে হেঁটে যাওয়া, পৌঁছাতে দেরি হলে খেতাম শিক্ষকদের বকুনি, শাস্তিও ছিল কড়া। এখন এদিক থেকে শান্তি ক্লাস শুরু হওয়ার ১ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠলেই যথেষ্ট, স্মার্টফোন/ল্যাপটপ নিয়ে টেবিলে বসেই এক আঙ্গুলের চাপে ক্লাসে ঢুকে গেলাম, কোন ব্যাপারই না কিন্তু। এতসব কিছুর ফাঁকেও কোথাও যেন কিছু একটা নেই। স্কুলে গেলে ক্লাস তো করতেই পারব এই আশ্বাস ছিল কিন্তু ডিভাইস নিয়ে বসে আছি ক্লাসে ঢুকতে পারছি না এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। দীর্ঘদিন লকডাউন এর ফলে পড়াশোনায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
বিশ্ব চিরাচরিত শিক্ষা ব্যবস্থা কোভিড-১৯ এর কারণে ব্যাপকভাবে তার পরিবর্তন ঘটে। পূর্বের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে যে শিক্ষাঙ্গন মুখরিত থাকতো তা আজ শূণ্য। বর্তমানে মহামারি পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে অনলাইন পাঠদান কর্মসূচি চলমান রয়েছে। ঢাকার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এন্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর মানবিক শাখার ছাত্রী ফারিয়া আলম অন্তরার সাথে এ বিষয়ে কথা হয়। সে জানায় আমার কলেজে নিয়মিত অনলাইন পাঠদান কর্মসূচি চলছে। প্রতিটি ক্লাস, শ্রেণি কার্যক্রম, অনলাইন শ্রেণি পরীক্ষা, অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা এবং বর্তমানে একাদশ বার্ষিক পরীক্ষা এখন চলমান। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কলেজ কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। অন্তরা ঢাকায় বসবাস করঔের বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে গ্রামে অবস্থান করছে। তবে এখানে ইন্টারনেট সুবিধা পেতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাছাড়া গ্রামে ওয়াইফাই পরিসেবা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তাই মোবাইল ডাটা ব্যবহার করতে হয়, এতে অর্থ খরচ বেশি এবং নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়াা থাকে। তাছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকার কারণে ইন্টারনেটের গতি ধীর, অনেক সময় ক্লাস করতে গেলে বাফারিংসহ দুর্বল হয়ে পড়ে। অনলাইন পাঠদানের ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট না থাকা একটি অন্যতম বাধা। তবে এলাকার স্থানীয় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইন পাঠদান এর অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যারা অন্তর্ভুক্ত তাদের নিয়মিত ধারাবাহিক কোন ক্লাস হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শ্রেণির পড়া কলেজ গ্রæপে ভিডিও দিয়ে দেওয়া হয়। তবে ঐ পড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের প্রশ্ন বা সমস্যা থাকলে সমাধান করা হচ্ছে না।
তাছাড়া করোনাকালিন সময়ে এলাকার বাল্যবিবাহ মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে। কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার কারণে অগণিত বাল্যবিবাহের কারণে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে। শহরের শিক্ষার্থীরা গ্রামীণ শিক্ষার তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ডাটা প্যাক তাদের পড়াশোনার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। ইন্টারনেট পরিসেবা অনলাইন কর্মসূচি শহরকে শিক্ষার্থীদের জীবনে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেবদূত হয়েছে, অপরদিকে গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা সেই দেবদূতের দেখা না পেয়ে অন্ধকারে বসে আছে।
অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম যেমন একদিকে সুবিধা দিচ্ছে তেমনি অসুবিধার মধ্যে বেশি বেশি স্মার্টফোন ব্যবহারে ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। লেখাপড়া হয়ে পড়েছে গতিহীন, বৈশ্বিক মহামারির এই সময়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অতিরিক্ত ডাটা কেনা, ইন্টারনেট স্পিড, ওয়াইফাই থাকলেও লোডশেডিং এর সমস্যার মধ্যে পড়ছে অনলাইন ক্লাস। করোনাকালিন সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্থিরতা, হতাশাসহ নানাবিধ মানসিক সমস্যা অনুভূত হচ্ছে। তারই মাঝে অনলাইন ক্লাস প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইন্টারনেট কঠিন বাস্তবতার কারণে গ্রামে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতেও পারছে না। অনলাইন ক্লাস সামাজিক ও আর্থসামাজিক বৈষম্যকে আরো প্রখরভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা ২৩ মার্চ বন্ধ ঘোষণা করার পর বারবার পিছানোর ফলে করোনা পরিস্থিতি ভালো না হওয়ার কারণে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জেএসসি ও এসএসসি ফলাফলের ভিত্তিতে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সালের জেএসসি পরীক্ষা গ্রহণ করাও সম্ভব হয়নি। তাছাড়া প্রতিটি ক্লাসের বর্ষিক পরীক্ষা পরবর্তীতে সরকারি নির্দেশনায় অ্যাসাইনমেন্ট এর মাধ্যমে উপরে উন্নীত করা হয়। এমনকি ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষা ফেব্রুয়ারিতে এবং এপ্রিলে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও ইতিমধ্যে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস এর আলোকে সীমিত সংখ্যক ক্লাসের পাঠদান এর মাধ্যমে শেষ করে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় তা এখনো সম্ভব হচ্ছে না। এসএসসি পরীক্ষা নভেম্বরে এবং এইচএসসি পরীক্ষা ডিসেম্বর মাসে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন উচ্চ শিক্ষায় অনলাইন ও অফলাইনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়ে সেশন জটের হাত থেকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে।
বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জুম অ্যাপস, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট, ফেসবুক লাইভ, ইউটিউব এর মতো বিভিন্ন সাইট ব্যবহার করে তাদের শিক্ষকদের সাথে ক্লাস করছে। এছাড়া সংসদ টিভি ও রেডিও এর মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত ক্লাস প্রচার করে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াাশোনার গতিকে চাঙ্গা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
শহর-গ্রামের সব শিক্ষার্থী যাতে সমান সুযোগ পায় সেজন্য আমাদের নিজেদের উপযোগী করে অনলাইন ক্লাস এর পদ্ধতি বেছে নিতে হবে। সবার জন্য অনলাইন ক্লাস সফল হোক ও প্রতিটি শিক্ষার্থী পূর্বেও মতো শ্রেণি কক্ষে ফিরে আসুক এই প্রত্যাশা রইল।
প্রকাশ কুমার দাস
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (আইসিটি)
মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এন্ড কলেজ
ও
ICT4E Dhaka District Ambassador,
Shikkok Batayan, a2i
প্রয়োজনে: ০১৫৫২৪১৪৬৮২
ই-মেইল: prokashdas68@gmail.com
ওয়েবসাইট : www.prokashitcare.com