ইন্টারনেট আসক্তির ইতিকথা
ইন্টারনেট আসক্তির ব্যাপারটা প্রথমবারের মত মনোবিজ্ঞানীদের নজরে আসে ১৯৯৭ সালে Cincinnati Case-এর মাধ্যমে। Sandra Hacker নামে একজন মহিলা তাঁর তিনটি শিশু সন্তানকে নির্জন কামরায় আবদ্ধ রেখে দৈনিক ১২ ঘন্টারও বেশি সময় ইন্টারনেটে অতিবাহিত করতেন। এই মহিলাকে পর্যবেক্ষণ করে মনোবিজ্ঞানীদের অনেকেই সম্মত হলেন যে, সিগারেট, মদ ও ড্রাগের মত ইন্টারনেটেরও cornpulsive ক্ষমতা আছে অর্থাৎ একটি পর্যায়ে মানুষ ইচ্ছার বিরুদ্ধেও যা ব্যবহার করতে বাধ্য হতে পারে। এই ধারণা থেকেই ‘Internet Addiction’ কথাটির সৃষ্টি। এক কথায় ইন্টারনেট আসক্তিকে প্রকাশ করা একটু কঠিন। ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে মানুষের যে ব্যাপক কৌতুহল, সার্বক্ষণিক চিন্তা, অদমনীয় ইচ্ছা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং অসংযত আচরণবোধ এসব কিছুকেই একসাথে ইন্টারনেট আসক্তি বলা যায়।
কতখানি এর বিস্তার?
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ইন্টারনেটের ব্যাপ্তিরও পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত। আসছে নতুন নতুন ফিচার, ফাংশন, কনসেপ্ট। সেইসাথে দিনদিন বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা। এক জরিপে দেখা গিয়েছে যে, মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে ৫-১০ % ইন্টারনেটে মারাত্মক ভাবে আসক্ত। এই সংখ্যা যে দিনদিন বাড়ছে, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
ইন্টারনেট আসক্তির প্রভাব
ইন্টারনেট আসক্তি মানুষের মস্তিষ্কে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করে। মাদক বা অ্যালকোহল গ্রহণের পর পরিবর্তন এবং ইন্টারনেট আসক্তির ফলে পরিবর্তন, মোটমুটি একই রকম। সম্প্রতি চীনের একদল বিশেষজ্ঞ ইন্টারনেট আসক্ত ১৭ জন তরুণের মস্তিষ্কে এধরনের পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন। ইন্টারনেটের অযাচিত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে মানুষ এর প্রতি তীব্রভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে । তার মেধা-মনন ও চিন্তা-চেতনার সবকিছু আচ্ছন্ন থাকে ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল কালো মেঘে। এর প্রতি সঙ্গনিরোধের সব প্রচেষ্টা যেন হয় ব্যর্থ। শিক্ষাগত, পারিবারিক ও সামাজিক দায়দায়িত্ব পালনের চেয়ে ইন্টারনেটের অযাচিত অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারই হয়ে ওঠে অত্যাবশ্যকীয়। শিক্ষাগত জীবনে নেমে আসে ব্যর্থতা।
পারিবারিক ও সমাজ জীবনে দেখা দেয় নানা টানাপোড়ন। কর্মক্ষেত্রে নেমে আসে স্থবিরতা। দাম্পত্যজীবনে সম্পর্কছেদ তথা বিবাহবিচ্ছেদ, কর্মক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতি যেন ইন্টারনেট আসক্তদের মধ্যে অতি সাধারণ ব্যাপার। আক্রান্ত ব্যক্তির অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যাপক দৈন্যদশা। আসক্ত ব্যক্তির জীবনে দেখা দেয় একাকিত্ব ও হতাশা। শারীরিক দিক থেকে আসক্ত ব্যক্তিদের একটি বড় অংশই নিদ্রাহীনতা, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কোমর ব্যথাসহ প্রভৃতি এক বা একাধিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আসক্তির আতিশয্যে আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক আত্মহত্যা কিংবা খুন করার মতো ঘটনাও বিরল নয়।
এক জরিপে দেখা যায়, শতকরা ২১ ভাগ দক্ষিণ কোরিয়ার ও ১৩.৭ ভাগ চীনা তরুণ-তরুণী এ সমস্যায় আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এই সমস্যায়ে আক্রান্তদের শতকরা হার যথাক্রমে ১.৫ ও ৮.২ ভাগ। বাংলাদেশে এই সমস্যার ব্যাপকতা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত বিস্তৃত কোনো জরিপ করা হয়নি। তবে ২০১৫ সালে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির ৪০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে করা এক সংক্ষিপ্ত জরিপে দেখা যায়, অংশগ্রহণকারীদের শতকরা ২৫.৩ ভাগ ইন্টারনেটের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। তা ছাড়া, ২০১৬ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ও মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আর এই ব্যবহারকারীদের শতকরা ৩৫ ভাগই সদ্য বয়োঃপ্রাপ্ত কিংবা উঠতি তরুণ-তরুণী। কাজেই আমাদের দেশে এই সমস্যা যে নিকট ভবিষ্যতে ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশে এবং মহাদেশে আসক্তির ছোঁয়া
বর্তমানে বাংলাদেশসহ সমগ্র পৃথিবীতে মাদকাসক্তির মতোই পটানো আসক্তি যেন একত্ব পূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাধারণত মানসিকভাবে অপরিপক্ক বিদ্যালয় ও কলেজগামী শিক্ষার্থীরাই এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হয়। সহজলভ্য পর্ণ, আকর্ষণীয় ভিডিও গেমস, সোশ্যাল মিডিয়ার অবাধ নিয়ন্ত্রণহীন বিস্তার, টিকটক, লাইকি সহ নিত্য নতুন অ্যাপসের সমাহার ইন্টারনেট আসক্তির মাত্রা বাড়াচ্ছে শতগুণ।
আমরা এবং ইন্টারনেট আসক্তি
করোনা মহামারীতে আমরা পরিবারের সবাই কমবেশি ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলতা অনেকখানি বাড়িয়েছি। এই নির্ভরশীলতা যেন আসক্তির পর্যায়ে না যায়, তা নিশ্চিত করা।
আমাদেরই দায়িত্ব। পরিবারই আমাদের জীবনের প্রথম পাঠশালা। আবার পরিবার তথা মা-বাবার যথাযথ সান্নিধ্যের অভাব কিংবা পারিবারিক টানাপোড়ন সন্তানের নিজস্ব স্পেস খুজে নেওয়া এবং তাতে নিরন্তর বুদ হয়ে থাকবার নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারে। মা-বাবা দুজন মিলে সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম দেয়া ও নৈতিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে এ সমস্যা অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। সেই সাথে সমাজে নৈতিক শিক্ষার প্রচলন, সুস্থ বিনোদনের পরিবেশ, ইন্টারনেটের পরিকল্পিত ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নজরদারী নিশ্চিত করতে হবে। ইন্টারনেটের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে সচেতনতাই পারে এই বিষফোঁড়া থেকে আমাদের বাঁচাতে।