মানসিক স্বাস্থ্য
মানসিক স্বাস্থ্য কি?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানসিক স্বাস্থ্য হলো এমন একটি কল্যাণকর অবস্থা যখন একজন ব্যাক্তি তার নিজস্ব দক্ষতা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন; ফলে জীবনের চলতি পথের সকল বাধা বা ধকলগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে এবং সামাজিক ও পারবারিক জীবনে কার্যকর অবদান রাখতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য হলো আমাদের মন, আচরণ ও আবেগের একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থা। আমরা কি চিন্তা করি, কি অনুভব করি এবং জীবনের বাধাগুলো সামলাতে কি রকম ব্যবহার করি এগুলোই আসলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য নির্দেশ করে। একজন মানসিক ভাবে সুস্থ মানুষ অনাকাক্ষিত আবেগ যেমন রাগ, ভয়, হিংসা, অপরাধবোধ বা উদ্বেগ দ্বারা প্রভাবিত হন না। জীবনে যখন যেরকম চাহিদা আসে তা সামলে নেওয়ার ক্ষমতা তিনি রাখেন।
Brain Food
কেন মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ?
মানসিক ও শারিরীক স্বাস্থ্য সমান গুরুত্বপূর্ণ ও একটি অন্যটি দ্বারা প্রভাবিত। যেমন- হতাশা অনেক ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নানা ধরনের দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা যেমন- ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হার্ট ডিজিজ ইত্যাদি হতাশার কারণে হয়ে থাকে। আবার একই ভাবে এইসব দীর্ঘ মেয়াদী রোগের অসুস্থতা মানসিক অসুস্থতার কারণ হতে পারে।
মানসিক অসুস্থতার হার কেমন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কমন স্বাস্থ্য সমস্যা হলো মানসিক অসুস্থতা। গবেষণা মতে,
- ৫০% এর বেশি নাগরিক জীবনের কোন না কোন সময়ে মানসিক অসুস্থতায় ভোগে।
- প্রতি ৫ জনে একজন নাগরিক প্রতি বছর মানসিক অসুস্থতায় ভোগে।
- প্রতি ২৫ জনে একজন নাগরিক মারাত্মক মানসিক অসুস্থতা নিয়ে বেঁচে থাকে। যেমন- সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার অথবা মারাত্মক হতাশা।
মানসিক স্বাস্থ্য কি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে?
মানসিক স্বাস্থ্য নানা ফ্যাক্টর দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় নানা কারণে এটা পরিবর্তন হতে পারে। যদি সামর্থ্য ও দক্ষতার চেয়ে চাহিদা বেশি থাকে। তখন মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। যেমন- কেউ যদি অর্থনৈতিক সংকটে থাকে বা টানা অনেক ঘন্টা ধরে কাজ করে তাহলে তার মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
মানসিক রোগের কারণ কী?
মানসিক রোগের নির্দিষ্ট কোন কারণ নেই। বেশ কয়েকটি কারণে মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে, যেমনঃ
- ছোটবেলার কোন প্রতিকূল অভিজ্ঞতা (সহিংসতার সাক্ষী হওয়া বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া)
- ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের চলমান দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসার অভিজ্ঞতা
- মস্তিষ্কের ভারসাম্যহীনতা
- অ্যালকোহল বা ওষুধের ব্যবহার
- একাকীত্ব বা বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি
মানসিক রোগের ধরণ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রতি বছর ১০ অক্টোবর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা তৈরীর লক্ষ্যে ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ পালন করে। ২০২১ সালের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের শ্লোগান ছিলো- “Mental health care for everyone: let’s make it a reality”. মানসিক অসুস্থতার ৩০০ এর অধিক ধরণ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত কয়েকটি হলো-
- মুড ডিজঅর্ডার।
- এংজাইটি ডিজঅর্ডার
- পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার
- মানসিক ব্যাধি
- খাওয়া সংক্রান্ত রোগ
- মেন্টাল ট্রমা
মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় আমাদের করণীয় কী?
করোনাকালে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার এই সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রাখতে আমরা যেগুলো করতে পারি, তা হচ্ছে-
- সারা দিনের ক্লান্তির পর ঠান্ডা পানিতে গোসল ডিপ্রেশন দূর করতে সাহায্য করে। হাইড্রোথেরাপি অলটারনেটিভ মেডিসিনের একটা অংশ।
- নিয়মিত মেডিটেশন এবং শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা।
- শরীরের যত্ন নেওয়া এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া।
- প্রতিদিন অল্প কিছু সময়ের জন্য হলেও ব্যায়াম করা।
- নিজের অভিজ্ঞতা ডায়েরী বা অন্য কোথাও লিখে রাখা।
- আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের সাথে কথা বলা।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের ১৪ টি উপায়
১) কাউকে নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি করবেন না । কে কী করছে সে বিষয়ে মাথা ঘামানো নিজের মানসিক চাপ বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ ।
২) আপনার যতটুকু দায়িত্ব ও কর্তব্য ততটুকু পরম আন্তরিকতার সাথে পালন করুন । আপনার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলতে যাবেন না ।
৩) মানুষের সাথে অতিরিক্ত সম্পর্ক মানসিক চাপের অন্যতম কারণ । কাজেই আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী, অধীনস্থ সকলের সাথে সীমিত সম্পর্ক রাখুন । সম্পর্ক যত ব্যাপক হবে আপনি ততটাই পেরেশানির সম্মুখীন হবেন ।
৪) অতিলোভ করবেন না । অল্পে তুষ্টি মানসিক শান্তির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
৫) সাধ্যের বাইরে নিজের অর্থ – সম্পদ কারো জন্য উজাড় করে দিবেন না । যারা কৃত্রিমভাবে নিজের সব কিছুকে উৎসর্গ করে দেয় তারা মানুষের কৃতজ্ঞতা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে ।
৬) আজকের দিনটিকে ভালভাবে উপভোগ করুন । আগামী কাল কী হবে সেটা সৃষ্টিকর্তার উপর ছেড়ে দিন । দুনিয়ারি বিষয়ে আগামীর চিন্তায় অস্থির হয়ে মানসিক চাপ বৃদ্ধি করবেন না ।
৭) প্রতিদিন একান্ত নির্জনে কিছু সময় কাটান । এ সময় সৎ চিন্তা করনি।
৮) জ্ঞানীদের জীবনী পড়ুন , তাদের উপদেশ ও মূল্যবান বাণীগুলো পড়ুন ।
৯) জীবনে যত বিপদ ও সমস্যাই আসুক সহজভাবে মেনে নিন । সৃষ্টিকর্তার লিখিত বাইরে কিছুই ঘটে না । বিপদ আপদেই হয়ত কল্যাণ রয়েছে যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না ।
১০) মনে আনন্দ বজায় রাখুন , মানুষের সাথে দেখা – সাক্ষাতে হাসতে শিখুন ।
১১) শরীরকে বিশ্রাম দিন । প্রয়োজনীয় খাবার, ঘুম, বিশ্রাম গ্রহণ করা জরুরি ।
১২) দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ কাজের লিস্ট তৈরি করে আগেরটা আগে পরেরটা পরে করুন । অগোছালো কার্যক্রম মানসিক অস্থিরতা বাড়ায় এবং মানসিক চাপ তৈরি করে ।
১৩) ‘প্রতিটি কাজ ১০০ পার্সেন্ট নির্ভুল করতে হবে ‘ এই চিন্তা মাথা থেকে সরাতে হবে । কেননা, পূর্ণাঙ্গতার গুণ কেবল মাত্র সৃষ্টিকর্তার ।
১৪) নিশ্চিত থাকুন, সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক যত গভীর হবে সব কাজ তত সহজ হবে । সকাল – সন্ধ্যার প্রার্থনার মাধ্যমে মনে অফুরন্ত প্রশান্তি বর্ষণ করে , সমস্যা দূর করে আর তখন জীবন হয়ে উঠে আরও প্রাণবন্ত , স্বাচ্ছন্দ্যময় ও আল্লাহর ভালবাসায় সুরভিত।
আমাদের পারস্পরিক সহমর্মিতা এবং সহযোগিতায় গড়ে উঠবে আগামীর সুন্দর সুখময় সময়।