ফ্রিল্যান্সিং
অনলাইনে কাজ করার মার্কেটপ্লেস
ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং। এই মুক্ত পেশায় তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বেশ। ঘরে বসে বিদেশের তথ্যপ্রযুক্তির নানা কাজ করে আয় করেন ফ্রিল্যান্সার বা মুক্ত পেশাজীবীরা। কিন্তু শুরুটা কীভাবে করতে হবে, ফ্রিল্যান্সার হতে কী জানতে হবে—এ নিয়ে দ্বিধা অনেকের।
অনেকেই মনে করেন, ফ্রিল্যান্সিং মনে হয় কোনো পেশার নাম। আসলে তা নয়। এটা কাজের ধরন মাত্র। কোনো প্রতিষ্ঠানের হয়ে পূর্ণ বা খণ্ডকালীন চাকরি করার মতোই মুক্ত পেশাজীবী হিসেবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরাই ফ্রিল্যান্সার। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় বর্তমানে অনেকেই ঘরে বসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা প্রতিষ্ঠানের কাজ করছেন, যাঁরা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। তবে এ পরিচয়টি আরও বিস্তারিত হলে ভালো হয়। অর্থাৎ অনলাইন বা সরাসরি (অফলাইন) কোনো প্রতিষ্ঠানের হয়ে যদি কেউ গ্রাফিকসের কাজ করেন, তবে তিনি ‘ফ্রিল্যান্স গ্রাফিক ডিজাইনার’ হিসেবে নিজের পরিচয় দিলে ভালো হয়।
আউটসোর্সিং কী
অনেকেই বলে থাকি, আউটসোর্সিং করা। বাইরের কোনো উৎস থেকে কাজ করিয়ে নেওয়াকেই মূলত আউটসোর্সিং বলে। আর তাই যাঁরা ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করেন, তাঁরা মূলত অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আউটসোর্স করা কাজগুলো করে দেন। একটু উদাহরণ দিয়ে বলি, ধরুন এটুজেড নামের ভিনদেশি প্রতিষ্ঠানের দ্রুত কিছু গ্রাফিকসের কাজ করানো প্রয়োজন। এ কাজ তারা নিজেদের কর্মী দিয়ে করাতে পারে অথবা বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান বা কর্মীর মাধ্যমে করাতে পারে।
কর্মী নিয়োগ বা ব্যবস্থাপনার জটিলতা এড়াতে গ্রাফিকসের কাজে দক্ষ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ করানোটাই আউটসোর্সিং। এ জন্য যাঁরা অনলাইনে কাজ করেন, তাঁরা যদি নিজেদের পরিচয় আউটসোর্সিং করেন বলে দাবি করেন, তবে তা ভুল হবে।
কাজ পাব কোথায়
অনলাইনে কাজ করার মতো অনেক মার্কেটপ্লেস আছে, সেগুলোতেই সাধারণত বেশির ভাগ ফ্রিল্যান্সার কাজ পান। এ ছাড়া অনেকেই নিজের ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কডইন ইত্যাদি) সরাসরি ক্লায়েন্ট বা গ্রাহক বা নিয়োগকারী খুঁজে তাদের চাহিদামতো কাজ করেন। অনলাইনে ফ্রিল্যান্স কাজ খুঁজে পাওয়ার জন্য বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য মার্কেটপ্লেস রয়েছে। এসব মার্কেটপ্লেসে কাজ করার পর অর্থ পেতে কোনো সমস্যা হয় না। এগুলো হলো upwork.com, freelancer.com, fiverr.com, peopleperhour.com এবং guru.com।
এই মার্কেটপ্লেসগুলোতে চাইলেই কাজ পাওয়া যায় না। কাজ পাওয়ার জন্য আপনি যে বিষয়ে দক্ষ তা উল্লেখ করে প্রথমে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এরপর কর্মী নিয়োগকারীদের চাহিদার সঙ্গে নিজের দক্ষতা মিলে গেলে কাজটি করার জন্য আবেদন করতে হবে। আপনার দক্ষতা বিবেচনা করে যোগ্য মনে করলেই নিয়োগকারী আপনাকে কাজ করার সুযোগ দেবে। তবে এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, নিয়োগকারীর শর্ত মেনে অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য আপনাকে কাজটি জমা দিতে হবে।
অনলাইনে যেসব কাজের সুযোগ রয়েছে
অনলাইনের বিভিন্ন ধরনের কাজ করা যায়। লেখালেখি, গ্রাফিকসের পাশাপাশি ওয়েব ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গান সম্পাদনা, থ্রিডি অ্যানিমেশন, ডেটা এন্ট্রি, লিড জেনারেশন, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) ইত্যাদি কাজ রয়েছে অনলাইনে। বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসের জব সেকশনে ঢুঁ মারলে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।
পূর্ণকালীন ও ফ্রিল্যান্স কাজের পার্থক্য কোথায়
পূর্ণকালীন ও ফ্রিল্যান্স কাজের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের হয়ে পূর্ণকালীন কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে গিয়ে কাজ করতে হবে। অপর দিকে ফ্রিল্যান্স কাজ করার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। আপনার সুবিধামতো সময়ে কাজ করা যাবে। তবে প্রতিষ্ঠানে দলগতভাবে কাজের সুযোগ থাকায় বিভিন্ন জনের সহায়তা পাওয়া যায়, কিন্তু ফ্রিল্যান্স কাজ করার সময় নিজেকেই সব কাজ করতে হয়। শুধু তা–ই নয়, নিয়োগদাতার সঙ্গে আলোচনা করে তার চাহিদামতো কাজ করারও দক্ষতা থাকতে হয়, যা বেশ চ্যালেঞ্জিং।
অনেক ক্ষেত্রে সময়ের তারতম্যের কারণে বিভিন্ন দেশের নিয়োগদাতার জন্য গভীর রাতেও কাজ করতে হতে পারে। তবে যত সমস্যাই হোক না কেন, স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ থাকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে। দক্ষতা ও ধৈর্য থাকলে এ পেশায় প্রাতিষ্ঠানিক চাকরির তুলনায় বেশি আয় করা যায়। চাইলে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি আয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি করা সম্ভব। তবে মনে রাখতে হবে, ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভালো করার জন্য বেশ সময় লাগে। আর তাই ধৈর্য নিয়ে কাজ করার মনোভাব থাকলেই কেবল ফ্রিল্যান্স কাজ করা উচিত।
নিজেকে ফ্রিল্যান্স কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা
অনেকেই মনে করেন, স্বল্প সময় দিয়ে ফ্রিল্যান্স মার্কেটে কাজ করে অর্থ আয় করবেন। তবে বাস্তবতা হলো, অল্প সময় দিয়ে এ সেক্টরে টিকে থাকা অনেক কষ্টের বা প্রায় অসম্ভব। আমার দেখা শত শত মানুষ আছেন, যাঁরা ভালো কাজ জানেন, তারপরেও পূর্ণকালীন কাজের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করতে গিয়ে তা করতে পারেননি। এই খাতে মনোযোগ, সময় দেওয়া ও আগ্রহ ছাড়া এগিয়ে যাওয়া অনেক অনেক কঠিন।
তো কেউ যদি ভেবে থাকেন কিছু অবসর সময়ে, পড়াশোনার পাশাপাশি বা বাসার কাজ শেষ করে অল্প কিছু সময় ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করবেন, তাঁদের বলব, সে ক্ষেত্রে এ খাত থেকে খুব বেশি কিছু আশা না করে কাজ করে যাওয়াই ভালো হবে। কিছু পেলে খুশি থাকলেন, আর না পেলে অভিযোগ করার কিছু নেই।
নিজেকে যদি এই খাতের ‘রকস্টার’ বানাতে চান, তাহলে সময় দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। চিকিৎসক, প্রকৌশলীদের মতো প্রতিনিয়ত পড়াশোনা ও গবেষণার ওপর থাকতে হবে। আর ভালো একটা সময় দিতে হবে এর পেছনে। নিজের মূল দক্ষতা, এর পাশাপাশি ইংরেজিতে কথা বলা ও লিখতে পারা, নিজের কাজ বিপণন করে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া, প্রতিনিয়ত ভালো কাজ করে গ্রাহকের কাছ থেকে ভালো ফিডব্যাক (রিভিউ) আদায় করা, পেশাদারিভাবে কাজ করা এবং পুরো প্রক্রিয়াটিতে পেশাদার থাকা; এসব কিছুর সংমিশ্রণই একজন ভালো ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আপনাকে গড়ে তুলবে এবং আপনিও হতে পারবেন এই খাতের একজন রকস্টার।
আপনি নিজে যে কাজ পারেন, সে কাজের চাহিদা ফ্রিল্যান্স মার্কেটে আছে কি না, সেটা বের করার চেষ্টা করুন। আর যদি আপনি যে কাজ পারেন, সে কাজ ফ্রিল্যান্স মার্কেটে চাহিদা না থাকে, তবে আপনার দক্ষতার সবচেয়ে কাছাকাছি কী কাজ মার্কেটপ্লেসে আছে, সে কাজ শেখার প্রস্তুতি নিন।
বর্তমানে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে সাধারণত দুই ধরনের কাজ বেশি করেন ফ্রিল্যান্সাররা। রিমোট ও প্রকল্পভিত্তিক কাজ। রিমোট কাজ বলতে দূর থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করাকে বোঝায়। এ পদ্ধতিতে কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার মতোই প্রতি মাসে ১৪০ থেকে ১৬০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। দিন দিনই এ ধরনের কাজের চাহিদা বাড়ছে।
কারণ, অনলাইনে কাজ করিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকায় সরাসরি কর্মী নিয়োগ দিতে হয় না প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ফলে অফিস পরিচালনা ব্যয় কম হয়। ফ্রিল্যান্সারদের কাছেও এ ধারনের কাজ বেশ জনপ্রিয়। কারণ, অনলাইন মার্কেটপ্লেসে নিয়মিত কাজ খোঁজার চেয়ে রিমোট কাজ বেশ স্বচ্ছন্দে করা যায়। এতে নিয়মিত আয়ও করা যায়। বর্তমানে ছোট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও রিমোট কাজের জন্য কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজে সুযোগ নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পাবে।
অনলাইন মার্কেটপ্লেসের প্রকল্পভিত্তিক কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা প্রায় সবাই কমবেশি জানি। এ ধরনের কাজগুলো (গ্রাফিকস, ওয়েব, ভিডিও সম্পাদনা, নিবন্ধ লেখা, অনলাইন সহকারী ইত্যাদি) মূলত ব্যক্তিগত প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। এসব কাজ করার জন্য অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোতে অনেক দক্ষ কর্মী থাকায় বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই নিজেদের কাজগুলো আউটসোর্স করে থাকে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ দেওয়ার আগেই ফ্রিল্যান্সারদের কাজের অভিজ্ঞতা, মান এবং সফলতার হার দেখা যায়। ফলে সহজেই দক্ষ কর্মী খুঁজে পাওয়া যায়। বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিই।
ধরুন, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একটা ওয়েবসাইট তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্রে ওয়েবসাইটটি তৈরি করতে ৫ থেকে ১০ হাজার ডলার খরচ হলেও একই কাজ অনলাইন মার্কেটপ্লেসে ২ থেকে ৪ হাজার ডলারের মধ্যে করানো সম্ভব। এ জন্য ওয়েবসাইটটি তৈরি করতে আগ্রহী ফিল্যান্সারদের বিস্তারিত তথ্য পর্যালোচনা করে দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে কম খরচে নিজেদের প্রয়োজনমতো ওয়েবসাইট তৈরি করা যাবে। ক্লায়েন্ট এবং ফ্রিল্যান্সার—উভয়ই লাভবান হওয়ায় অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ পাওয়া যায় যেভাবে
অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে একই কাজের জন্য কয়েক শ ফ্রিল্যান্সার নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছেন। ফলে চাইলেই ইচ্ছেমতো কাজ পাওয়া যায় না অনলাইন মার্কেটপ্লেসে। ক্লায়েন্টরাও চায় কম খরচে দক্ষ ব্যক্তির মাধ্যমে কাজ করিয়ে নিতে।
ফলে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ পেতে হলে নিজেকে নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষ করার পাশাপাশি নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে হবে। ক্লায়েন্টের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের পাশাপাশি কাজ নির্দিষ্ট সময়ে জমা দিতে হবে আপনাকে। মনে রাখতে হবে, কাজের মান খারাপ হলে ক্লায়েন্ট আপনাকে কম রেটিং দেবে, যা দেখে অন্য ক্লায়েন্টরা আপনাকে আর কোনো কাজ দেবে না। একাধিকবার কম রেটিং পেলে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে আপনি আর কাজ করতে পারবেন না।